

৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলেন বিশ্বখ্যাত উরুগুয়ান নেতা হোসে মুহিকা
বিশ্বব্যাপী ‘সবচেয়ে সাধারণ জীবনযাপনকারী প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে পরিচিত উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা আর নেই। ৮৯ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জনগণের ভালোবাসা ও আদর্শিক দৃঢ়তার প্রতীক হিসেবে পরিচিত এই সাবেক গেরিলা যোদ্ধা ‘পেপে মুহিকা’ নামেও ছিলেন ব্যাপকভাবে পরিচিত।
২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট পদে থাকা মুহিকা একজন আদর্শ রাজনীতিক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তার জীবনযাত্রা ছিল একেবারে সাধারণ—মাঠে কাজ, পুরনো গাড়ি, সাদামাটা পোশাক আর নিজ বাড়িতে বসবাস। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও তিনি রাজধানীর রাজপ্রাসাদে না থেকে শহরের বাইরের একটি ছোট বাড়িতে বসবাস করতেন। তার স্ত্রী লুসিয়া টোপোলানস্কি, যিনি নিজেও একজন রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন গেরিলা, ছিলেন তার অনুগত সঙ্গী।
উরুগুয়ের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু ওরসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক জানিয়ে লেখেন, “আপনার দেওয়া শিক্ষা ও ভালোবাসার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।” যদিও মুহিকার মৃত্যুর সঠিক কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হয়নি, ধারণা করা হচ্ছে তিনি দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যনালীর ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
বিপ্লব থেকে রাষ্ট্রপতির আসনে
১৯৬০-এর দশকে তুপামারোস গেরিলা সংগঠন গঠনে ভূমিকা রাখেন মুহিকা। সংগঠনটি তখনকার ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালাত। এ সময় তিনি বারবার গ্রেফতার হন, নির্যাতনের শিকার হন এবং দীর্ঘ ১৪ বছর কারাভোগ করেন। এমনকি তাকে নিভৃত কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়।
কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং সংসদের নিম্ন ও উচ্চকক্ষের সদস্য হন। ২০০৫ সালে তিনি মন্ত্রিপরিষদে যুক্ত হন এবং ২০১০ সালে রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন। তার শাসনামলে গাঁজা বৈধকরণ, গর্ভপাতের অধিকার ও সমলিঙ্গের বিবাহের স্বীকৃতি দিয়ে উরুগুয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে।
সাদামাটা জীবন ও ত্যাগী মনোভাবের প্রতিচ্ছবি
মুহিকার জীবনযাপন ছিল নিঃস্বার্থ ও স্বচ্ছ। নিজের বেতনের বড় একটি অংশ তিনি দান করতেন। একটি পুরনো ভক্সওয়াগেন গাড়ি চালিয়ে অফিসে যেতেন, গৃহকর্মী বা দেহরক্ষী ছাড়াই বসবাস করতেন। তিনি নিজেকে “গরিব প্রেসিডেন্ট” বলতে অস্বীকার করে বলেছিলেন, “গরিব তারা যারা কখনোই তৃপ্ত হয় না, চায় আরও বেশি।”
তবে তার সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে বিরোধীদের সমালোচনার মুখেও পড়েছিলেন। বিশেষত শিক্ষা খাতে অগ্রগতির অভাব ছিল একটি বড় সমালোচনার জায়গা।
নেতৃত্বের উত্তরাধিকার ও শেষ সময়ের কথা
২০২০ সালে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন। এরপরও দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনায় তার অবস্থান ছিল কেন্দ্রীয়। ২০২৪ সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার দল ফের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
গত বছর মুহিকা জানান, তার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। মৃত্যুর বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “মৃত্যু আমাদের সবার জন্য অনিবার্য—এটি জীবনের মধ্যে লবণের মতো।”
তার মৃত্যু শুধু উরুগুয়ের নয়, সমগ্র বিশ্ব রাজনীতির এক আদর্শ ও মানবিক মুখের বিদায়।